নিলাম হাটে কিসের আনন্দ খুঁজে ফিরি আমরা অভাগার দল! তকতকে দেয়াল, ছাদ, মেঝের ঝকমকে আলোয় সুসজ্জার আবরণে মৃদু আচ্ছাদন- একটু শান্তির হঠাৎ ধাক্কা। নাকে দামি পারফিউমের মায়াবি আবেশ- এতেই বেশ!-নাকি শেষ?
দুর্ভাগা বাঙালি- সে তো শত শত বছর ধরে নিলাম পণ্য হয়ে কোনমতে বেঁচেবর্তে আছে আজও। বাঙ্গালির অতি দীর্ঘ একটা সময় আমরা বিদেশীদের কাছে গোলাম-সম মূল্যায়ন (!) নিয়ে ছিলাম। পরে প্রতিবেশী তারপরে নিজেদের কাছে নিজেরা। সেই দীর্ঘসময় ধরে চলমান এই নিলাম নিলাম খেলায় একটা ছোট গোষ্ঠী সবসময় বাকিদের নিলামে তুলেছে। আগে বেনিয়াদের কাছে বিক্রি হতাম, এখন নিজেদের জাতির লোকের কাছে নিজেরা।
কখনও এই দলের নামে, কখনও সেই দলের নামে নিলাম ডাকা হয়। গোপন আঁতাতে সামান্য কিছু সংখ্যক লোক এই নিলাম নিলাম খেলার ছক আঁকে। একসময় নিজের অজান্তেই কোটি কোটি মানুষ হয়ে যায় স্রেফ পণ্য- নিলাম পণ্য।
মনুষ্যত্বের ব্যাকুল ঝরনা আজ সমতলে ঝাঁপিয়ে পড়ার দুঃসাহস করে না। কিন্তু বিভ্রাটের বিভ্রমে নিলামকারী আর নিলাম পণ্য কেনার খণ্ড কিছু লোকেরা আকাশ সমান বিস্তৃত মানুষগুলিকে বেচা-কেনায় সক্রিয় অংশগ্রহন করে যাচ্ছে। ক্রয়ি-বিক্রয়ি মানুষগুলোর অস্থিমজ্জায় লুকিয়ে থাকা বিশাল বিশাল জগৎগুলি সসীম গণ্ডিতে লুকিয়ে থাকে-সবার অজান্তে।
আশায় থাকি- ‘নতুন কোন গানের ভাষা জীবন পেয়েছে আর মনুষ্যত্বের আকাশের লজ্জা ঢাকা মেঘ হয়েছে!
(কৃতজ্ঞতায় নচিকেতা)
কানার হাটবাজার থেকে বেহুদা প্যাঁচাল-
১) বেশ ছুটি কাটালাম। ঈদের মত মোটামুটি লম্বা ছুটি। বেশিরভাগ সময়ই শুয়েবসে দুর্বিষহ সময় কাটিয়েছি। দায়ী ‘বিদ্যুৎ’ ভাই! মাঝে ছোট ভাইদের সাথে মজার আড্ডা। বাকি অফুরন্ত সময়ে কতকিছু যে ভাবনার আকাশটাকে হঠাৎ হঠাৎ কালো মেঘে ঢেকে দিয়ে যায়! টুপ টুপ বৃষ্টির কোন সন্ধান পাইনি, পাইনি প্রাশান্তির কোমলতা, বিদ্যুৎ বিভ্রাট আর গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ঘুমের সাথে তীব্র সংঘর্ষ করতে করতে কত কথা যে মনকে বিষাদে ভরে দিয়েছে!
মনের পর্দায় একটা সংলাপ ঝপাং করে মাথার উপর এঁটে বসে। বাহ! কথাটা তো বাস্তবতার সাথে হুবহু মিলে যায়!
“নিজের মারমার কাটকাট অবস্থা বজায় রাখতে হলে অনেকেই ভুল কিছু সিদ্ধান্ত নেয়। মারমার কাটকাট বিশাল মাপের মানুষের চোখে অপরাধীকে তার অপরাধের শাস্তি দেয়া হবে। সিদ্ধান্ত হল- আসামিকে (!) দিগম্বর করে সারা বাজার ঘুরিয়ে নিয়ে আয়। শরীরে এক রত্তি সুতাও যাতে না থাকে। তথাস্থ- সারা বাজার দিগম্বর করে আসামিকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসা হল। বিশাল মাপের মানুষটি সাজা কার্যকর করা আসামির চোখের দিকে তাকান। বিশাল মাপের মানুষটি লোকটির চোখে কিছুই খুঁজে পেলেন না- না ভয়, না অভিমান, না অসহায়ত্ব। কোন এক সুদূরে তার দৃষ্টি। বিশাল মাপের মানুষটিকে তাড়িয়ে বের করার পর বিজ্ঞ একজন বলে উঠলেন-
আজ তোমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন এবং ভয়ংকরতম শত্রু সৃষ্টি করলে।
বিশাল মাপের মানুষটি ঠা ঠা করে বিকট হাস্যে দেয়াল, ছাদ কাঁপিয়ে দিলেন। অকথ্য কিছু বাক্য শেষে বিশাল লোকটি পরিহাসের তরলতায় ভাসতে ভাসতে বললেন- এটা আমার শত্রু হবে! তাও আবার কঠিন এবং ভয়ংকরতম!-আরেকদফা অট্টহাস্য- চাচা, তুমি তো ভালোই হাসাতে যান দেখছি!
ঘিরে থাকা শক্ত চেহারার লোকগুলিও একসাথে হেসে ওঠে। ওদের হাসতে হয়- বুঝেও হাসে, না বুঝেও হাসে- নিজস্ব ভাবনার কোন বেগ নেই- বিশাল মানুষের সাথে তাল মিলাতে সবই করতে হয়।
গাম্ভীর্য ধরে রেখে বুড়ো লোকটা বলে- শোন একটা কথা বলি-
ওকে যদি তুমি নগ্ন করে সারা শরীরের চামড়া তুলে নিতে, আর তারপরও যদি সে বেঁচে থাকত, তাহলে আজীবন তোমাকে ভয় পেত- শুধুই প্রচণ্ড ভয়। আজ ওর শরীর থেকে আচ্ছাদন তুলে নিয়ে রাস্তায় ঘুরালে- যতক্ষণ ঘুরালে সেই সময়ের ভিতর ওর ভিতরে প্রতিশোধের যে দানবের জন্ম হল, সেই দানব তোমাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করেই থামবে। ওর ভিতরের আত্মসম্মানবোধই অপ্রতিরোধ্য দানবের রূপ নিয়েছে।”
২) মহাভারত পালার চরম মুহূর্তের একাংশে সীতা যখন ‘লক্ষ্মণ রেখা’ অতিক্রম করে ছদ্মবেশী রাবণকে ভিক্ষা দিতে আসলেন আর রাবণের দ্বারা অপহৃত হন। পালার এই পর্যায়ে দর্শক সারি থেকে একজন প্রচণ্ড ক্ষোভ ঝাড়লেন- সীতা মা এটা কি করল! তিনি যদি ‘লক্ষ্মণ রেখা’ অতিক্রম না করতেন তাহলে কি লঙ্কাকাণ্ড হত! পাশে বসা বয়স্ক দর্শক বললেন- বেটা, মাঝে মাঝে সীতার মত ‘লক্ষ্মণ রেখা’ অতিক্রম করতে হয়। প্রথম দর্শকের বড় বড় চোখ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললেন- সীতা যদি ‘লক্ষ্মণ রেখা’ অতিক্রম না করতেন, তাহলে লঙ্কাকাণ্ড হতো না, আর রাবণের মত রাক্ষসদের বিনাশও হতো না কোনদিন- কি, ভুল বললাম?