Probhat Barta

বৃহস্পতিবার, ১৪ই নভেম্বর, ২০২৪, দুপুর ১২:৪১ মিনিট

অনুসরণ করুনঃ

শেষ রাত্রির আর্জি : ফাতেমা জাহান লুবনা

নয়ন আর নদীর বিয়ে হয়েছে প্রায় এক যুগ অতিক্রম হয়েছে। অভিভাবকদের সম্মতিক্রমে নিজেদের পছন্দের বিয়ে। নদী অপরূপা সুন্দরী, মাথায় ঘন কালো কোঁকড়া চুল, মিষ্টি চেহারা আবার নয়নও কিন্তু দেখতে বেশ সুঠাম সুপুরুষ। দু’জনে যেন মানিক জোর। এত সুখের মাঝেও নদীর গভীরে কষ্ট জমা হয়ে থাকে সবসময়ই। মাঝেমধ্যেই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে হৃদয়ের শূন্যতাকে জানান দিয়ে যায়। বিয়ের এতটা বছর পার হয়ে গেল অথচ তার কোল জুড়ে এখনও কোন সন্তান এল না – তার কি তাহলে এ জীবনে আর ‘মা’ ডাক শুনা সম্ভব হয়ে উঠবে না? ওদিকে তার শাশুড়িও অস্থির বড় ছেলের ঘরে নাতি- নাতনি দেখার জন্য। ছেলেকে অনেকবার দ্বিতীয় বিবাহের কথা বললেও ছেলে তাতে মাথা পাতেনি। নয়ন সবসময় বলেছে:

“আল্লাহ্ যদি আমার ভাগ্যে সন্তান লিখে রেখে থাকেন তাহলে নদীর মাধ্যমেই হবে, আর যদি তা না লিখে রাখেন তাহলে বিয়ে কয়েকটি করেও লাভ হবে না।”

অবশ্য যদিও নয়ন শহরের বড় বড় হাসপাতালে গিয়ে নদীকে ডাক্তার দেখিয়েছে আর সব হাসপাতালের ডাক্তার নদীর সমস্যা আছে তাই তাদের সন্তান হবে না বলেই রিপোর্ট দিয়েছে তবুও নদীকে মন থেকে দোষারোপ করতে সে কখনওই রাজি ছিল না আর এমন কিছু করতেও রাজি ছিল না যাতে সে কষ্ট পায়।

নয়নের মা স্ত্রীর প্রতি ছেলের ভালোবাসা দেখে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তাকে না জানিয়ে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাজ্জাদকে অনুরোধ করেন এক মেয়ে দেখতে নিয়ে যেতে। নয়নের মায়ের দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয়ার মেয়ে খুশি; শিক্ষিতা আবার বেশ সুন্দরী। নয়ন যাতে টের না পায় এমনভাবে দেখাতে হবে সাজ্জাদকে। বাধ্য হয়ে নয়নের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাজ্জাদ তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হবার নাম করে খুশিদের বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে থাকে। এক সময় সাজ্জাদ বলে:

“দোস্ত! আমার বেশ পানি পিপাসা পেয়েছে। চল এক বাড়িতে ঢুকে পানি পান করে আসি।”

এই বলে সাজ্জাদ পরিকল্পনা মাফিক নয়নকে নিয়ে প্রবেশ করে খুশিদের বাড়িতে। খুশির অভিভাবকেরা এমনকি খুশি নিজেও জানত আজ তাদের বাড়িতে নয়নের আসার কথা। নয়ন সরকারি চাকুরিজীবী আবার ভাল বংশের ছেলে, উত্তম চরিত্রের অধিকারী তাই বিয়ের ব্যপারে তাদের তেমন কোন আপত্তি ছিল না। সাজ্জাদ পানি চাইলে হরেক রকম পীঠা, চা -বিস্কুটসহ পানি হাজির করা হল। আর সেই সাথে নানীর হাত ধরে হাজির করা হল খুশিকে। বুদ্ধিমান নয়নের বুঝতে কিছু বাকি থাকল না কি ঘটতে চলেছে। নয়ন তাদের বাড়ির টয়লেটটা কোথায় জানতে চাইলে তাকে তা দেখিয়ে দেওয়া হল বাড়ির পিছনের দিকটায়। সুযোগ বুঝে টয়লেটে যাবার নাম করে কাউকে না জানিয়ে নয়ন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেল; নিজেদের বাড়িতেও ফিরে এল না।

একবার নয়ন আর নদীর দাওয়াত এল নয়নের মামা বাড়িতে সেঝ মামার ঘরে। কত কি রান্নার আয়োজন করা হল: পোলাও, দুই পদের মাংস, তিন – চার পদের মাছ, বেশ কয়েক পদের ভর্তা আর সেই সাথে পীঠা-পায়েস। নয়নের মামার পূর্বপুরুষরা অনেক আগে জমিদার ছিলেন। এখন আর জমিদারির প্রচলন না থাকলেও তার নানা আর পরবর্তীতে মামারা ঐ এলাকার চেয়ারম্যান। নয়নের মা তার বাবার বাড়ির বিঘার পর বিঘা সম্পত্তির মালিক ছিলেন। যদিও তিনি তা নেওয়ার চিন্তা ততটা করতেন না তবু তার ভাইদের কথা ছিল:

“বুবু চাইলে আমরা তাকে তার সম্পত্তি দিয়ে দেব।”

কিন্তু নয়নের বাবার তাতে তেমন আগ্রহ ছিল না কারণ তার নিজেরই বিঘার পর বিঘা সম্পত্তি ছিল। নয়নকে ছোট বেলা থেকে মামাবাড়ির সবাই খুব আদর যত্ন করতেন তার সহজ সরল মন আর দুরন্তপনার জন্য। যাহোক সেঝমামার ঘরে তারা যথাসময়ে দাওয়াত খেতে হাজির হল। খাবার শেষ হবার পরে নয়নের বৌ দেখতে গ্রাম থেকে কিছু মহিলা আসলেন। তাদেরকে নয়নের মামী নাস্তা দিলেন আর সেই সাথে পান-সুপারি খেতে দিয়ে তাদের সাথে গল্প করতে লাগলেন। গল্পের ফাঁকে নদীর সামনেই তাদেরকে বললেন:

“নয়নের বৌ তো আটকুরা – বাঁঝা। এত বছর হয়েছে নয়ন বাবাজির বিয়ে হয়েছে অথচ বাছা ছেলেমেয়ের মুখ দেখতে পারল না!”

এই কথা শুনার পর নদী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। পাশের রুম থেকে নয়নের কানে পৌঁছাল তাদের কথাবার্তা। নয়ন রুমে এসে বলল,

“চল নদী! এখানে আর এক মুহূর্তও নয়। যেখানে তোমাকে আটকুরা – বাঁঝা বলে অপমান করে সেখানে আমি আর থাকতে চাই না।”

নয়ন যে সন্তান-সন্ততি পছন্দ করত না বা তার সন্তনাদির জন্য মন খারাপ হত না বিষয়টা তা নয়, তবে নদীর প্রতি গভীর ভালোবাসার কারণে সে কখনওই তা প্রকাশ করতে চায়নি। মাঝেমধ্যে সে বিস্কুট কিনে নিয়ে তার গ্রামের বাড়ির স্কুলের সামনে বড় মাঠটায় যেত যেখানে ছোটছোট ছেলেমেয়েরা খেলা করত। সেও তাদের সাথে খেলত। ঐ মাঠের অধিকাংশ জমি নয়নের দাদারা দান করে দিয়েছিলেন এলাকার মানুষের কল্যাণে। যাহোক সে সবাইকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে নিজে দূরে একস্থানে দাঁড়াত। সবাই দৌঁড়ে তার কাছে এসে যদি ‘আব্বা’ বলে ডাকত তবে তাদের জন্য উপহার স্বরূপ থাকত সেই মজার বিস্কুট। ছেলেমেয়েরাও খুশি আর নয়নও তাতে অনেক খুশি হত ‘বাবা’ ডাক শুনতে পেয়ে।

নদীর মন ভালো করার জন্য তাকে নিয়ে প্রায়শঃ ঘুরতে বের হত নয়ন। কিনে দিত বাদাম ভাজা, চটপটি, ফুসকা অথবা খেতে নিয়ে যেত কোন খ্যাতিমান হোটেলে। আবার কখনও নদীর পাড়ে বা পার্কে বসে গল্প করত দু’জনে মিলে। বিয়ের বছর পাঁচেক পরে গ্রামের বাড়ি থেকে তাকে শহরে নিয়ে আসে নয়ন। সেখানে একা একা বড় বাড়িতে নয়ন অফিসে চলে গেলে নদীর মন যেন খাঁ খাঁ করে উঠে। আর মনে মনে ভাবে যদি তাদের একটা বাবু থাকত সবকিছুই যেন পরিপূর্ণতা পেত। নয়নের মত স্বামী পেয়ে সে নিজেকে যথেষ্ট ভাগ্যবতী মনে করে। শুধু একটা সন্তানের জন্য তার মাতৃহৃদয় যেন হাহাকার করে উঠে! ’মা’ ডাক শুনার জন্য ব্যাকুল হৃদয়ে স্মরণ করে স্রষ্টাকে। নয়ন আর নদী শেষ রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে আল্লহ্ র কাছে মোনাজাত করে :

“হে আল্লহ্! তুমি পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু। তুমি সকল ক্ষমতার অধিকারী। তুমি ইচ্ছা করলে রাজাকে পথের ভিক্ষারী বানাতে পার আবার পথের ভিক্ষারীকে রাজা বানাতে পার, নিঃসন্তানকে সন্তান দিতে পার আবার সন্তানওয়ালাকে নিঃসন্তান করতে পার। তুমি ইচ্ছা করলে সকল কিছু করতে পার আল্লহ! আমাদেরকে তোমার পক্ষ থেকে নেকসন্তান দান কর যারা দেশের এবং দশের উপকার করতে পারবে। আমীন।”

মহান আল্লাহ্ তাদের শেষ রাত্রির আর্জিকে ফিরিয়ে দেননি। আর আল্লাহ্ তো তার বান্দাদের বলেই দিয়েছেন তিনি রাত্রির শেষ অংশে চতুর্থ আসমানে এসে হাজির হন বান্দাদের আর্জিকে কবুল করার জন্যই। তাদের বিবাহের ষোলো বছর পরে নদী আর নয়নের সুখের সংসারে পরিপূর্ণতা দিতে আর তাদের আটকুরা নাম ঘুচাতে মহান আল্লাহ তাদের এক কন্যা শিশু প্রদান করেন। তার নাম রাখা হয় লাবিবা। দুজনে মিলে পরম যত্নে তাকে মানুষ করতে থাকেন তারা । একসাথে গোসল করিয়ে দেন, ঘুম পাড়ান , ঘুরতে বের হন। সুখের পরিপূর্ণতায় তারা স্রষ্টার কাছে সর্বদা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে থাকে আকাশছোঁয়া ভালোবাসায়…..

(গল্পটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা)

About The Author

শেয়ার করুন :

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সম্পর্কিত: