Probhat Barta

বৃহস্পতিবার, ১৪ই নভেম্বর, ২০২৪, রাত ১১:২৮ মিনিট

অনুসরণ করুনঃ

ভালবাসা ও শবযাত্রা

রহমত আলী রাত নয়টায় বাড়ি ফিরে ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়ে মাজেদা বেগমকে চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন, কইগো দরজা খোল। মাজেদা বেগম দরজার ওপাশ থেকে স্বামীর ডাক চিৎকারে বেশ অবাক হলেন। শান্ত, নিরীহ গোছের মানুষটা আজ এতো অস্বাভাবিক আচরণ করছে কেন! কোন সমস্যা নাকি?

মাজেদা বেগম দরজা খুলে স্বামীর দিকে তাকালেন। সব ঠিক আছে। শুধু চেহারাটা কোন এক অপ্রত্যাশিত সুখপ্রাপ্তিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। আর রহমত আলী মিটিমিটি হাসছেন- সুখী মানুষের হাসি। মাজেদা বেগম দরজা থেকে একপাশে সরে গিয়ে স্বামীকে ভিতরে আসতে দিলেন। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, আলীম কই?

আলীম আবার কি করবে, ও পড়ছে।

ওকে একটু ডাকো। আর সখি, তাহমিনা ওরা কই?

এখন ডাকার দরকার নেই। একটু আগে আলীম বলেছে পড়া শেষ করে তারপর খাবে। সখিও তোমার সাথে খাবে, ভাইয়ের সাথে পড়ছে। তাহমিনা ঘুমিয়ে গেছে। তুমি হাতমুখ ধুয়ে আসো। তোমার আদরের ছেলে-মেয়ের জন্য অপেক্ষা করার ফাঁকে একটু জিরিয়ে নাও।

বাইরের কল থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসে জামাকাপড় বদলানোর ফাঁকে রহমত আলী স্ত্রীকে বললেন, আজ আসার সময় হেডস্যারের সাথে কথা হলো। তিনি আমার আলীমকে নিয়ে অনেক আশাবাদী। অনেক বছর পর নাকি আলীমের মতো একজন ছাত্র পেয়েছেন। এবছর ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ও নাকি খুব ভালো রেজাল্ট করবে। দেখতে হবেনা কার ছেলে, রহমত আলীর ছেলে। রহমত আলী হেসে উঠে বলতে লাগলেন, ও অনেক বড় হবে, অনেক নাম করবে। মাজেদা বেগম পরিহাস করে বললেন, ছেলে তো তোমার একার! রহমত আলী হাসতে হাসতে বললেন, আরে জানইতো আমাদের বংশের পুরুষরা অল্প বয়সে মারা যায়। বড় মানুষ ছেলে আর সুখী মেয়েদের নিয়ে তুমিইতো রানীর মতো দিন কাটাবে। মাজেদা বেগম স্বামীর মুখে হাত দিয়ে অশ্রুসজল কণ্ঠে বললেন, এমন কথা আর কখনো বলবেনা। স্বামী-স্ত্রী এক অপার্থিব সুখের আবেশ নিয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এসময় আলীম এসে জানালো রিভাইস দেয়া শেষ। এখন খাবো।

খাবার সময় রহমত আলী বললেন, কালকে আমি তোর সাথে পরীক্ষা কেন্দ্রে যাবো। বাপ, বেটা একসাথে যাবো আবার একসাথে ফিরে আসবো। জিএম স্যারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে এসেছি।

মাজেদা বেগম একটু আশ্চর্যই হলেন। আঠারো বছরের বিবাহিত জীবনে তাঁকে মাত্র একদিন ছুটি কাঁটাতে দেখেছেন। তাও রহমত আলী’র মায়ের মৃত্যুর দিন। দুনিয়াটা বড়ই আজব। তিন ছেলে-মেয়ের জন্মের সময়ও তাঁকে পাশে পাননি। মাজেদা বেগম আশ্চর্য হয়ে ভাবেন, তাঁর কি ঈর্ষা হচ্ছে! দূর, কি ভাবছি এসব। মন থেকে সবকিছু ঝেড়ে ফেলে তিনি চারজনের খাবার বাড়তে লাগলেন।

খাবার শেষ করে বিছানায় যেতে যেতে বেশ রাত হয়ে গেলো। মাজেদা বেগম অবাক হয়ে লক্ষ্য করছেন রহমত আলী কেমন যেন ছটফট করছেন। কতক্ষণ পরপর বিছানায় উঠে বসছেন। বিছানার পাশে গিয়ে ঘুমন্ত ছেলের দিকে ঘোরলাগা, মায়াভরা চোখে তাকিয়ে থাকছেন। আলতো করে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে কি যেনো বলছেন। হয়তো দোয়া করছেন। সারাটা রাতই রহমত আলী এভাবে কাটিয়ে দিলেন। মাজেদা বেগমের চোখেও ঘুম নেই। সহজ সরল মানুষটার প্রতি তার অসম্ভব ভালবাসা। লোকটা নিজের ভোগ বিলাসের জন্য কোনকিছুই করলেন না। উপার্জনের সবটাই দু’হাত খুলে ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ গড়ায় ব্যয় করে যাচ্ছেন।

পরদিন সকাল আটটায় বাপ, ছেলে রিক্সা করে পরীক্ষার হলে রওনা দিলো। আগেরদিন রহমত আলী রিক্সাওয়ালাকে বলে রেখেছিলেন। ভাড়া একটু বেশি। তাতে কি! পরীক্ষার দিন রিক্সা পাওয়াটাও এক তেলেসমাতি কাণ্ড। কিছু টাকা না হয় বেশিই গেলো। সারা রাস্তা বাপ, ছেলে নিশ্চুপ অবস্থাতেই পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছালেন।

পরীক্ষা শেষে রহমত আলী ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, পরীক্ষা কেমন হয়েছে বাবা? ছেলে আলীম উচ্ছসিত স্বরে বলল, অনেক ভালো হয়েছে বাবা। দোয়া করো। পরের পরীক্ষাগুলো ছেলে একাই রিক্সা করে পরীক্ষা দিতে গেলো।

সর্বশেষ পরীক্ষার দিন রহমত আলী ছেলের সাথে গেলেন। পরীক্ষা শেষে ছেলেকে নিয়ে বাসায় ফেরার সময় ছেলের পরীক্ষা কেমন হলো জিজ্ঞেস করেই থেমে থাকলেন না। ছেলের সাথে বন্ধুর মতো গল্প জুড়ে দিলেন। তার মনটাও আজ বেশ ফুরফুরে। আল্লাহ’র রহমতে আলীমের সবগুলো পরীক্ষাই অসম্ভব রকমের ভালো হয়েছে। হেডস্যারও পরীক্ষার সময় আলীমের খোঁজখবর নিতে বাসায় গিয়ে রহমত আলীকে এসব জানিয়েছেন।

পরীক্ষার কথা বাদ দিয়ে রহমত আলী হঠাৎ করেই অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। বাবা, তুই আমাদের পরিবারের বড় ছেলে। ছয়মাস বয়সে হঠাৎ তোর প্রচণ্ড জ্বর আসে। ঐদিন তোর মায়ের B.com এর Accounting পরীক্ষা। আমি সহ তোর দাদা-দাদী সকলেই তাকে পরীক্ষা দিতে বলল। তোর মা কোনমতেই তার অসুস্থ ছেলেকে বাসায় রেখে পরীক্ষা দিতে যাবেন না। তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। দিনরাত সেবাশুশ্রূষা করে সুস্থ্য করে তারপর শান্ত হলেন। মাস তিনেক পর তোর মায়ের পরীক্ষার রেজাল্ট এর আগের রাতে হঠাৎ দেখি বিছানায় তোর মা নেই। বারান্দায় গিয়ে দেখলাম হাত পা ছড়িয়ে বসে আছেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখছেন আর নিঃশব্দে কাঁদছেন। আমি প্রায় ঘণ্টাখানেক তার পাশে বসে ছিলাম। তোর মা এমন বিভোর ছিলেন যে, আমার অবস্থানটাও তিনি টের পাননি। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে হতচকিত হয়ে গেলেন। আমি তার কষ্টটা বুঝতে পেরেছিলাম। তার মাথায় হাত রেখে স্বান্তনা দিতে গেলে তোর মা আমার বুকে মাথা রেখে বলল, আমার জন্য কষ্ট পেয়োনা। আমার ছেলে বড় হয়ে আমার চাওয়ার অপূর্ণতাটা পূর্ণ করবে।

রহমত আলী বুঝতে পারছেন না এতোটুকু ছেলের সাথে এভাবে বন্ধুর মতো কথা বলাটা ঠিক হচ্ছে কিনা।

আলীম চুপচাপ সব শুনে গেলো। বাবার কথার মাঝে একটি কথাও বলেনি। কখন যে পরীক্ষায় ভালো করার আনন্দগুলোকে কষ্টেরা দখল করে নিয়েছে টেরই পায়নি সে। মায়ের ভালবাসার কথাগুলি শুনতে শুনতে কখন যে চোখ দিয়ে পানি পরতে শুরু করেছে! চোখের এই পানি মায়ের কাছ থেকে পাওয়া ভালবাসার আনন্দ না মায়ের আত্মত্যাগের জন্য কষ্টের, কিছুই বুঝতে পারছেনা আলীম।

আজ রেজাল্ট। রহমত আলী গতকালই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে রেখেছেন। ছেলেকে সাথে নিয়ে স্কুলে গেলেন। এখনও রেজাল্ট শীট আসেনি। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবক সবার মধ্যেই চাপা উত্তেজনা। রহমত আলীর কেমন যেন লাগছে। টেনশনটা মনে হয় একটু বেশিই হচ্ছে। সিলিং ফ্যানের বাতাসের মধ্যেও তিনি ঘামছেন। কখন যে শেষ হবে এই প্রতীক্ষার!

দুপুর দেড়টার সময় হেডস্যার স্কুল গেইটে রিক্সা থেকে নেমে প্রায় দৌড়ে অফিস রুমে প্রবেশ করলেন। সকাল আটটায় উপজেলা শিক্ষা অধিদপ্তর অফিসে গিয়েছিলেন তিনি। স্বভাববিরুদ্ধ উচ্চকণ্ঠে অফিসে উপস্থিত শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বললেন, আজ আমাদের স্কুল থেকে একজন ছাত্র সাতটি বিষয়ে লেটার মার্কস সহ স্টার পেয়েছে। স্টার পাওয়া ছেলেটি হচ্ছে আলীম।

মুহূর্তেই সারা বিদ্যালয়ে খবরটি ছড়িয়ে পড়লো। অন্যান্য ঘটনাগুলি এমন আনন্দের খবরে চাপা পরে গেলো। এক মেয়ে পরীক্ষায় ফেল করাতে অজ্ঞান হয়ে পরে আছে এমন গুরুতর ঘটনাও অনেকক্ষণ পর জানা গেলো। কি আশ্চর্য সুন্দরভাবে সবকিছু ঘটছে। হেডস্যার আলীমকে কোলে তুলে নিয়ে মাঠের মাঝখানে হাজির হলেন। ছোটখাটো মানুষ তিনি। কিভাবে যে আলীমের মতো বাড়বাড়ন্ত একটা ছেলেকে কোলে তুলে মাঝ মাঠে নিয়ে গেলেন!

স্কুল থেকে বেরুতে বেরুতে প্রায় চারটা বেজে গেলো। বাজার থেকে মিষ্টি নিয়ে বাপ, ছেলে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। রহমত আলীর হাঁকডাকে মাজেদা বেগম বেরিয়ে আসলেন। বাপের কাঁধে ছেলে বসে আছে, একটু লজ্জা পাচ্ছে কি! বাপ, ছেলের বিশ্বজয়ের হাস্যমুখ দেখে তিনি স্বর্গীয় আনন্দ অনুভব করছেন। আলীম মিষ্টির প্যাকেট খুলে মা’কে মিষ্টি খাওয়াতে গেলে মাজেদা বেগম মুখ সরিয়ে নিলেন। আলীমের বিস্মিত চেহারা দেখে মাজেদা বেগম মুচকি হেসে বললেন, বাবারে, আজ আমি রোজা রেখেছি। ইফতারের পর প্যাকেটের সব মিষ্টি খেয়ে ফেলবো কিন্তু। রহমত আলী, আলীম দু’জনেই বুঝতে পারছে এ রোজা রাখাটা আলীমের ভালো রেজাল্টের প্রত্যাশায় মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে একটি আবেদন।

দিন যায়, মাস, বছরগুলিও যেন একটু দ্রুতই শেষ হয়। আলীম এখন ইন্টারমেডিয়েটের বিজ্ঞান বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র। কলেজের প্রথম বছরটি আলীম বেশ তোড়জোড় করেই লেখাপড়া চালিয়ে গেলো। ২য় বছর থেকে কি যে কি হলো। প্রায়ই বাবা এটা কিনতে হবে, ওটা কিনতে হবে বলে টাকাপয়সা টানতে শুরু করলো। মাজেদা বেগমও কলেজে পড়ালেখা করেছেন। ছেলের হঠাৎ জেগে উঠা চাহিদাগুলি তার কাছে বেখাপ্পা লাগতে শুরু করে। বিষয়টি নিয়ে রহমত আলীর সাথে আলোচনা করতে গেলেই তিনি এক ফুঁতে সব আশঙ্কা উড়িয়ে দেন। বলেন, জেনে রেখো আমাদের ছেলে কখনও খারাপ পথে হাঁটবে না।

কিন্তু দিন দিন আলীমের চাহিদা যেন বেড়েই চলছে। ছোট বোন দু’টির সাথেও ইদানীং বেশ রুক্ষ আচরণ শুরু করেছে। ঐদিনতো বড় মেয়ে সখিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। চৌকির কাঠের কোণায় লেগে রক্তারক্তি কাণ্ড। রহমত আলী এবার ব্যাপারটি বেশ গুরুত্বের সাথেই নিলেন। এবার একটু খোঁজখবর নিতে হয়।

খবর নিতে গিয়ে জানতে পারলেন, তার প্রানপ্রিয় সন্তান নেশার জগতে ভালোভাবে জড়িয়ে গেছে। কিভাবে কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার টাকা পয়সা দেবার ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। আলীমকে নিয়েও বসতে হবে। রহমত আলী এবং মাজেদা বেগম আলীমকে নিয়ে আলচনায় বসলেন। অনেক ভাবে ছেলেকে বুঝালেন। ছেলে ঢুলুঢুলু চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে সব শুনছে। রহমত আলী কি বুঝলেন জানা না গেলেও মাজেদা বেগম বুঝতে পারলেন পরিণতিটা। আলীমকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এপথ থেকে ফেরাতে হবে। মাজেদা বেগম সংগোপনে নিজের ভাই করিম ও একমাত্র দেবর হাসানের সাথে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করে কোন এক মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।

এরই মধ্যে সাজানো বাগানের মতো হঠাৎ সংসারে ঝড় বয়ে গেল। দুপুরের খাবারের পর মায়ের কাছে এক হাজার টাকা চাইলে মাজেদা বেগম নেই বলে জানালেন। মাজেদা বেগম লক্ষ্য করলেন, ছেলেটা আলীম নয়, অন্য কেউ একজন লাল চোখে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এসময় রহমত আলী সাহেব বাড়িতে হাজির হলেন। বিষয়টি শুনে তিনিও টাকা দিতে অস্বীকার করে ছেলেকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন। কে শুনে কার কথা – সাপের বিষ যেভাবে তীব্র ব্যাথা অনুভুত করতে থ্যালামাসের কোষ সমূহ ব্লক করে, ঠিক সেরকমভাবে আলীমকে হিরোইনের অভাব থ্যালামাসে বিষের যন্ত্রণা দিতে শুরু করে দিয়েছে।

আলীম চিৎকার করে মায়ের কাছে আবারও টাকা চাইলো। খারাপভাবে কি যেন একটা বলল? রহমত আলীর মাথায় রক্ত চড়ে গেলো। ভাতমাখা হাতেই ছেলের গালে সজোরে থাপ্পড় দিলেন। আলীম এখন আর মানবের মধ্যে নেই, সারা শরীরে বিষ ছড়িয়ে পরেছে, অসহ্য যন্ত্রণা। বাবাকে ধাক্কা দিয়ে মায়ের গলার স্বর্ণের চেইনটি টান দিয়ে দে ছুট। কতক্ষণ লাগবে আখড়ায় পৌঁছাতে?

রহমত আলী শারীরিকভাবে কোন চোট পেলেন না। কিন্তু কে যেন তাঁর হৃদপিণ্ডে অতর্কিতে ধারালো ছুরি বসিয়ে দিলো, এক্কেবারে মোক্ষম জায়গায়। তিনি কাত হয়ে পরে আছেন। নিশ্চুপ, নিথর।

সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হলো বাদ মাগরিব জানাজার পর লাশ দাফন করা হবে।

মাজেদা বেগম ঘরের খুঁটিতে হাঁটু মুড়ে বসে আছেন। প্রতিবেশী মহিলারা তাকে ঘিরে আছে। কেউ কেউ স্বান্তনা দিচ্ছেন। কিন্তু মাজেদা বেগমের চোখে পানি নেই, মুখে কোন শব্দও নেই। কোন কিছু তার কানে যাচ্ছে কিনা তাও কেউ বলতে পারছেনা। প্রতিবেশীরা এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।

আশ্চর্য! এরই মাঝে মাজেদা বেগমের বিয়ের প্রথম রাতের কথা মনে পরে গেলো। লোকটা যে কি লাজুক ছিল! বাসর ঘরে ঢুঁকে চৌকির এক কোনে চুপচাপ বসে ঘামছেন। মাজেদা বেগম ঘোমটার ফাঁক দিয়ে মানুষটির কাজকারবার দেখছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র খুন না করেও খুনের দায়ে তার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দেওয়া হয়েছে। একবারও নববধূর দিকে তাকিয়ে দেখছেন না। কেমন যেন অদ্ভুত লোকটা! ছেলের এস.এস.সি.’র রেজাল্ট শুনে কাঁধে করে ছেলেকে বাড়ি নিয়ে আসা। স্বামী-স্ত্রী’র একসাথে জ্যোৎস্না দেখা। মাঝ রাতে ক্ষেতের মাঝ দিয়ে হাতে হাত রেখে হেঁটে বেড়ানো। “বড় মানুষ ছেলে আর সুখী মেয়েদের নিয়ে তুমিইতো রানীর মতো দিন কাটাবে” সবগুলি স্মৃতি একসাথে জড়ো হতে লাগলো। তিনি কোনমতেই স্মৃতির বেড়াজাল থেকে বের হতে পারছেন না। তিনি অজ্ঞান হয়ে পরে রইলেন।

বাইরে লোকজনের সরগরম উপস্থিতি। সবাই আলীমকে খুঁজছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আলীমের কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যায়নি। সে বাড়ি নেই নাকি! হঠাৎ মাজেদা বেগম ঘর থেকে বলে উঠলেন, আলীম আর আসবেনা। আপনারাই দয়া করে সব ব্যবস্থা করেন।

চার কাঁধে চড়ে মৃত দেহ খাটিয়াতে করে রওনা দিলো জানাজা শেষে কবরে অবস্থান নেবার জন্য। হেডস্যার খাটিয়ার একটি কোণা কাঁধে তুলে নিলেন। বৃদ্ধ মানুষ। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। এটাকি শারীরিক কষ্ট? নিজেকেই প্রবোধ দেন, হয়তো। খাটিয়ার এপাশটা একদিন আলীমেরই কাঁধে নেবার কথা ছিলো।

About The Author

শেয়ার করুন :

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সম্পর্কিত: