নির্বাচন আমাদের জাতীয় উৎসব হিসাবেই সবসময় বিবেচিত হয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে বাছাই করার সুযোগ পাই। সুযোগে আনন্দে আমরা বিভোর হই, প্রচণ্ড আবেগে কাঁপি, হাসি। – এই হচ্ছি আমরা, আমজনতা।
নির্বাচনের সময় ভোটারদের কেউ নিরপেক্ষ থাকে না। পক্ষের সঙ্গ দিতে গিয়ে আমাদের আনন্দ, কাঁপা-কাঁপি, হাসাহাসি বেড়ে যায় বহুগুনে। গলা ফাটানো মিছিল, অনিশ্চয়তার কম্পন!- সব মিলিয়ে চরম এক অনুভূতি!
বেশ কয়েকবছর যাবৎ এই প্রচণ্ড আনন্দ থেকে আম টাইটেলধারী জনতা বঞ্চিত হচ্ছে। যেখানে টাকার জোয়ার বয়ে যায়, সেখানে অনুভূতির স্বচ্ছ টলটলে ভাবটা বিলীন হয়ে যেতে বাধ্য। স্বচ্ছ টলটলে ভাবটা বিলীন হয়ে আসছে, হচ্ছে এবং হতে থাকবে। আমরাও মানিয়ে নেবার চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত, শ্রান্ত হয়ে তীরের মত বিঁধতে থাকা হীম শীতল বাতাসকে সঙ্গী করে ঘুমিয়ে থাকি। ঘুমিয়ে থাকতে বাধ্য হই।
আমাদের গরু বা ষাঁড় আছে আশেপাশের কচি ঘাস খেয়ে বেড়ায়। ওদের শিং আছে এবং গুঁতিয়ে দিলে মৃত্যু হতে পারে। আমাদের কুকুর আছে। কি ভয়ানক হিংস্র এক প্রাণী! যে কোন জীবের টুঁটি ছিড়বার সামর্থ্য রাখে। এসব গোধন আর কুকুরধন আমাদের গর্বের সম্পদ। অস্বীকার করা যায় না, এরা সত্যিই আমাদের সম্পদ। মানুষের সংসারে এরা কাজের জীব হয়ে কমবেশি সামাজিক জীব হয়ে উঠেছে। মানুষের আদরে সোহাগে ওরা গরু আর কুকুর মেজাজ মুছে ফেলেছে। মেজাজ খারাপ না হলে এরাও হিংসা করে না।
লোকটার মধ্যে রাজকতা কই? হর্ষধ্বনি কই? মানুষের চোখে ও’কে দেখলেই হাসি পায়। বেসুরা কণ্ঠ আর উল্টাপাল্টা অঙ্গভঙ্গিতে কৌতুক ভরপুর। বহু বছর আগে ফেলে আসা গ্রাম্যতার ম্যাটম্যাটে ভাবটি চেহারা, কথাবার্তায় বা অঙ্গভঙ্গিতে এখনও প্রকট। যেন ঐতিহ্যের কুশ্রী আর চেতনা সেই সুদূর থেকে ওর সত্তায় মিশে আছে।
ও এখন আধুনিক মানুষের মত স্বপ্ন দেখে। ভূষণে আভরনে ও সুখী-জীবনের কলহাস্যে সুন্দর নরনারীর শোভাযাত্রা পথ ধরে চলেছে- তার দু চোখ উৎসুক হয়ে শুধু এই দৃশ্যই দেখতে চায়। নগরের পথেই দাঁড়িয়ে সে কপোত, ময়ুর আর ঘুঘুর কলালাপ শুনতে চায়। তরুচ্ছায়ার তলেই ক্লান্ত শরীর জুড়িয়ে নিতে চায়। নগরের পথে দাঁড়িয়ে সে মাটির দিকে তাকিয়ে তৃণের শ্যামলতা ও আকাশের দিকে অপার নীলিমার বিস্ময় দেখতে চায়। বাংলার নাগরিক হতে চায়। রাজপথে দাঁড়িয়ে রাজকতা আশা করাই স্বাভাবিক। পথের পাশে ভাস্কর্যে তর্জনীর ক্ষমতাকে শ্রদ্ধা জানাতে চায়।
সে চায় কয়েকদিনের আগুনবিহীন চুলাতে কিছু মরা ডালপালা বা খুড়কুটো ঠুসে দিয়ে উত্তপ্ত করতে। দু’মুঠো চাল অন্তত আগুনের উপর সেদ্দ হোক। ও বঞ্চিত মানুষগুলির ঘরে গিয়ে আপন মানুষের মত মাটিতে বসে জীবনের গান গাইতে চাইছিল। হোক বেসুরা। ও যেসব ঘরে যেতে চাইছিল সেখানকার মানুষ অসুর-বেসুর বুঝে না। ওরা গীত শুনেই চমকিত হতো। এত উঁচু পদে থেকে কেইবা এমন পা ছড়িয়ে ঘরের মানুষের মত গান শোনায়? এত উঁচু পদের মানুষগুলি তো আর সহসাই চোখে পড়ে না; আবার হাত পা ছড়িয়ে গান শুনাবে!
আমরা বাঙ্গালীরা শহর কেন্দ্রিক হয়ে গেছি। শহর কেন্দ্রিক বাড়ীগুলির বিরাটত্ব আছে, আকার এবং প্রকার আছে। যেন একেকটা সুবিস্তৃত দুর্গের শহর- খাঁচায় ভাগ করা এক একটি জীবনের মহল্লা। পীচঢালা পথগুলি কঠিন ও মসৃণ বধ্যভূমির মত। শত রকমের মৃত্যুর যান ও যন্ত্র এই পথের উপর অবাধে পিচ্ছিল আনন্দে ছুঁতে চলছে। সর্বদিকে সংশয়। প্রতিটা ন্যায়ের দাবীর সম্মুখে ঘুষের অপচ্ছায়া হাত পেতে আছে। প্রতি ন্যায্য মূল্যের প্রতিদান ভেজালের ষড়যন্ত্রে ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। এখানে মানুষ আইন চালায় না, আইন মানুষকে চালায়- আর এই কথাটা আমজনতার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
শোভা নেই, দৃশ্য নেই, রাজকতা নেই- তবু সারাদেশে আমরা শোভা খুঁজি, আশ্বাস খুঁজি, স্বস্তি খুঁজি। সারা মনুষ্যত্বই যেন খুঁজতে খুঁজতে সন্ধানহীন শিকারীর মত দিশেহারা ও উদভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই বারবার পরাজিত হয় স্যুট, বুট পড়া বিরাট দেয়াল ঘেরা মানুষদের কাছে। কথিত মার্জিতরা, সুশীলরা, ক্ষমতার চেয়ারের আশেপাশে ঘুরঘুর করা মানুষরা ও’কে দেখতে পারে না বলেই ‘এই হাল’।
তারপরেও একটা স্যালুট সে অবশ্যই পাওনা। কেননা সে ঐসব ঈর্ষান্বিত মানুষের সামনে শীর্ণ শরীর নিয়েও দাঁড়াতে পেরেছে। বারবার ঠোকর খেয়েও নিরাশ হয়ে পড়ে থাকেনি, শুয়ে থাকেনি। লড়াই করেছে চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত। এসব কর্মই আরও বহু ‘হিরো’ কে মাঠে নামাতে অনুপ্রাণিত করবে।
“ফেরেশতা হবার দরকার নাই। স্রষ্টার স্বীকৃতি ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ এর একজন হতে পারাই যথেষ্ট।”